যুগপুরুষ প্রমথনাথ

*যুগপুরুষ প্রমথনাথ।*



ভারতে একটি লোহার কারখানা তৈরি করতে বিখ্যাত ব্যবসায়ী জামসেদজি নাসেরওয়ানজি টাটা আমেরিকা থেকে দুজন বিশেষজ্ঞ আনা হলেও তারা লোহার কারখানার যথাযথ স্থান নির্ধারণ করতে পারছিলেন না। জামশেদজীর সুযোগ্য পুত্র, ডোরাবজি টাটা সেই কাজে প্রত্যক্ষ পরামর্শের জন্য ডাকলেন ভারতবিখ্যাত এক বঙ্গসন্তান, তিনি ভূতত্ত্ববিদ পি এন বসু, আমরা তাঁকে চিনি প্রমথনাথ বসু নামে। সাকচী গ্ৰামে গড়ে উঠল টাটা শিল্প গোষ্ঠীদের ইস্পাত কারখানা। সেটাই ভারতের প্রথম লৌহ ও ইস্পাত কারখানা। সাকচীর বর্তমান নাম জামশেদপুর। আমাদের দেশে ইস্পাত শিল্প গড়ার প্রথম স্থপতি প্রমথনাথ। বলা বাহুল্য স্থপতির প্রেরণা, তাঁর পরামর্শ ও দূরদৃষ্টি কে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নতুন কোম্পানিতে প্রমথনাথ কে অংশীদারি দিতে চেয়েছিল টাটারা, যদিও সেই প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখান করেছিলেন মেধাবী মানুষটা, কারণ ব্যক্তিগত ভাবে এক নির্লোভ মানুষ। যার ছিল প্রবল আত্মসম্মানবোধ। ভারতে শিল্পায়নের যুগপুরুষ প্রমথনাথ।, বরাবর মেধাবী ছাত্রটি জন্মগ্ৰহন করেছিলেন ২৪পরগনা জেলার গোবরডাঙায়। 
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়য় প্রমথনাথ প্রথম ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মচারী। মাত্র সাত বছরে নিজের কর্মদক্ষতা প্রমাণ করে আরও উঁচুতে উঠেছিলেন। খনিজ সন্ধানী এই বিজ্ঞানী অক্টোবর মাসে সদলবলে বেরিয়ে পড়তেন, ফিরতেন এপ্রিলে।সেই সময় বেশিরভাগ ভূতাত্ত্বিক অভিযানের লক্ষ্যস্থল ছিল মধ্যপ্রদেশ। নয় বছরের বিপুল পরিশ্রম আর মেধার সংমিশ্রণে জানা গেল নর্মদা নদীর নিচের অংশের খনিজসম্পদ, রায়পুরের লিগনাইট কয়লা, জব্বলপুরের লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ ঘটিত খনিজের কথা। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলেন ময়ুরভঞ্জ রাজ্যের খনিজের অধিকর্তা হয়ে নতুন কাজ কে আরও প্রসারিত করলেন।

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের আচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন, পরে এর নতুন নাম হয় কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি। পরে এই প্রতিষ্ঠানের নাম হল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রমথনাথ বসুর একটি আবক্ষমূর্তি স্থাপিত হয়েছে এখানে।
প্রমথনাথ বসু শুধু একজন ভূতত্ত্ববিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী লেখক। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘A History of Hindu Civilization during British Rule’, ‘Epochs of Civilization’, ‘Civilization Through The Ages’, ‘The Illusions of New India’, ‘Swaraj— Cultural and Political’ বিশেষ/

ভারতে প্রথম দেশীয় সাবানের স্রষ্টা তিনিই, বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি ভূ-বিজ্ঞানী প্রমথনাথ বসু

Story image

বছরের প্রথম ছয় মাস কখনও ঘোড়া কিংবা উটের পিঠে চেপে, কখনও আবার তাঁবুতে, আবার কখনও গভীর অরণ্যে, পাহাড়ে, খরস্রোতা দুর্গম নদীতে নৌকা ভাসিয়েই কাজ করতে হত তাঁকে। এই বিবরণ শুনলে তাঁকে কোনো এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী বলেই মনে হবে। দুর্গম গিরি কান্তার মরু কেবলই তিনি খুঁজে চলেছেন, পরখ করে দেখছেন সব এলাকার মাটির গঠন, রূপবৈচিত্র্য। কখনও দার্জিলিং, কখনো সিকিম, কখনো আবার বরাকর-রানিগঞ্জ, আসাম কিংবা মধ্যপ্রদেশ। অনায়াস যাতায়াত ছিল তাঁর ভারতের সর্বত্র। করতেন ভারত সরকারেরই একটি চাকরি। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায়। ভূ-বিজ্ঞানী হিসেবে এভাবেই ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে হত তাঁকে। প্রথম ছয় মাস এভাবে রোমাঞ্চকর অভিযানে কাটিয়ে এসে পরের ছয় মাস ধরে অফিসের বদ্ধ দেয়ালের মধ্যে টেবিল-চেয়ারে বসে সেই অভিযান থেকে পাওয়া তথ্যাদির বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করতেন তিনি। পি এন বোস নামেই সকলের কাছে তিনি পরিচিত, পুরো নাম প্রমথনাথ বসু (Pramatha Nath Bose)। প্রথম বাঙালি ভূ-বিজ্ঞানী (Geologist) হিসেবে সমগ্র ভারতের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তিনিই খুঁজে বেরিয়েছেন খনিজ ও আকরিকের উৎস। 

স্বদেশি শিল্প প্রচারের জন্য ১৮৯১ সালে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ সম্মেলন। এমনকি ভারতে প্রথম আধুনিক পদ্ধতিতে দেশীয় সাবান তৈরির কারখানাও স্থাপন করেছিলেন প্রমথনাথ বসু।

স্বদেশি আন্দোলন (Swadeshi movement) তখন জোরকদমে চলছে পুরো বাংলা জুড়ে। দেশের নানা দিকে গড়ে উঠছে স্বদেশি শিল্প-কারখানা। প্রমথনাথ ছিলেন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। তিনি চাইতেন ভারতের খনিজ ও আকরিকের সম্ভারকে কাজে লাগিয়ে দেশীয় শিল্পের উন্নতি ঘটাতে, তবেই দেশের ধনসম্পদ বৃদ্ধি পাবে। স্বদেশি আন্দোলনের দিকনির্দেশ ঠিক কীরূপ হবে তা নিয়ে লিখে ফেললেন ‘উপায় কী?’ নামের একটি প্রবন্ধ। সেখানে প্রমথনাথ লিখছেন –  “তুলা হইতে কাপড়, ইন্ডিয়া রবার হইতে ওয়াটার প্রুফ, লৌহঘটিত আকরিক পদার্থ হইতে লৌহ এবং লৌহ হইতে ছুরি কাঁচি ইত্যাদি প্রস্তুত করাই শিল্পকর্ম্ম। শিল্পই দেশের ধনবৃদ্ধির উপায়।”

 টাটা কর্তৃপক্ষ প্রমথনাথকে বিনামূল্যে তাঁদের কোম্পানির ‘শেয়ার’ দিতেও চেয়েছিলেন, কিন্তু আদর্শবাদী খানিক একগুঁয়ে সেই প্রস্তাব সসম্মানে অস্বীকার করেন।

আর এই খনিজের সম্ভার খুঁজে খুঁজে বের করার দুঃসাধ্য প্রকল্পই ছিল প্রমথনাথের জীবনের মূল লক্ষ্য। তার সঙ্গে মিশেছিল স্বদেশি চেতনা। স্বদেশি শিল্প প্রচারের জন্য ১৮৯১ সালে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ সম্মেলন। এমনকি ভারতে প্রথম আধুনিক পদ্ধতিতে দেশীয় সাবান তৈরির কারখানাও স্থাপন করেছিলেন প্রমথনাথ বসু।

 রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) সঙ্গে সখ্যের সূত্রে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। দুঃসাহসী প্রমথনাথ একেবারে খাঁটি অভিযাত্রীদের মত রোমাঞ্চকর সব অভিযানের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রদেশের ধূলি ও রাজহরাতে আকরিক লোহা, রায়পুরে লিগনাইট কয়লা, দার্জিলিং-এ কয়লা, সিকিমে তামা, বরাকর ও রানিগঞ্জে অভ্র, জব্বলপুরে ম্যাঙ্গানিজ ও লোহা, ব্রহ্মদেশে কয়লা ও গ্রানাইট পাথর ইত্যাদি খনিজ আবিষ্কৃত হয়। ভারতের শিল্পের উন্নতির ক্ষেত্রে অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল প্রমথনাথের এই আবিষ্কার। 

বঙ্গভঙ্গের (Partition of Bengal) ঠিক আগে আগে, সাল ১৯০৩। ওড়িশার (Odisha) ময়ূরভঞ্জের স্টেট জিওলজিস্টের পদে কাজ করছেন প্রমথনাথ। এই সময়ই গরুমহিষানিতে অনুসন্ধানের ফলে লৌহ আকরিকের এক বিপুল উৎস খুঁজে পান তিনি। ঠিক তার পরের বছর ১৯০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সোজা চিঠি লিখে জামশেদজী টাটাকে তিনি জানান, তিনি যেহেতু ভারতে লৌহ-ইস্পাত শিল্পকে উন্নত করার কথা ভাবছিলেন, তাই তাঁর কাছে গরুমহিষানির এই লৌহ আকরিকের সম্ভারকে কাজে লাগিয়ে কাছাকাছি কোনো অঞ্চলে ইস্পাত কারখানা খোলাই লাভজনক উপায় হবে। সেই চিঠিতেই প্রমথনাথ বিস্তারিতভাবে ঐ অঞ্চলের আকরিকের সম্ভারের প্রাচুর্যের কথা জানিয়েছিলেন টাটাকে। প্রমথনাথের কথায় মান্যতা দিয়ে লোক পাঠালেন টাটা। সুবর্ণরেখা আর খরকাই নদীর মধ্যবর্তী অববাহিকায় নদী সঙ্গমে চললো ক্ষেত্র-সমীক্ষা আর পরে সেখানেই সাকচিতে তৈরি হয়ে গেল ভারতের প্রথম লৌহ-ইস্পাত কারখানা। কিন্তু ততদিনে জামশেদজী টাটা মারা গিয়েছেন, দায়িত্ব পড়েছে তাঁর পুত্র স্যার দোরাবজী টাটার কাঁধে। তাঁর উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানেই ১৯০৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গড়ে ওঠে ‘টাটা আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল ওয়ার্কস লিমিটেড’। আজ যে অঞ্চল জামশেদপুর নামে খ্যাত, তা এসেছে ঐ জামশেদজী টাটার (Jamshedji Tata) নামের অনুষঙ্গ থেকেই। তারপর তো ভারতের শিল্পের চেহারাটাই বদলে গিয়েছিল এই টাটা গ্রুপের হাত ধরে। পরে টাটা কর্তৃপক্ষ প্রমথনাথকে বিনামূল্যে তাঁদের কোম্পানির ‘শেয়ার’ দিতেও চেয়েছিলেন, কিন্তু আদর্শবাদী খানিক একগুঁয়ে সেই প্রস্তাব সসম্মানে অস্বীকার করেন। শুধু খনিজ-আকরিক সন্ধানই নয়, হরিদ্বারের পশ্চিম প্রান্ত থেকে জম্মু পর্যন্ত বিস্তৃত শিবালিক পাহাড়ে তিন ধরনের নর-বানর জাতীয় প্রাণীর জীবাশ্মও আবিষ্কার করেছেন প্রমথনাথ বসু। এই জীবাশ্মগুলির নাম তিনি দিয়েছিলেন যথাক্রমে শিব-পিথেকাস, ব্রহ্ম-পিথেকাস এবং রাম-পিথেকাস। 


‘আ হিস্ট্রি অফ হিন্দু সিভিলাইজেশন ডিউরিং ব্রিটিশ রুল’ (A History Of Hindu Civilization during British rule) তাঁর লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই। তাছাড়া নানা সময়ে বাংলাতেও লিখেছেন ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’, ‘ভারতে বিলাতী সভ্যতা’ ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। সেকালে ভারতের ভূতত্ত্ব বিভাগের একবারে উঁচু পদটি সব সাহেবদের পিছনে ফেলে অধিকার করেছিলেন প্রমথনাথ বসু। কিন্তু ব্রিটিশ পক্ষপাত ও বৈষম্যের হাত থেকে তিনিও মুক্তি পাননি। সাত বছরের মধ্যে প্রমোশন পেয়ে জিএসআই-তে (Geological Survey Of India) ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্টের পদে আসীন হলেও তার দু বছর পরেও পদটি স্থায়ী করা হয়নি। বরং তাঁর থেকে দশ বছরের জুনিয়র টমাস হেনরি হল্যান্ডকে বসিয়ে দেওয়া হয় প্রমথনাথের থেকেও উঁচু পদে। লজ্জায়, অপমানে চাকরিই ছেড়ে দেন প্রমথনাথ। আজকের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯০৬ সালে তখনও ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট’, (Bengal Technical Institute) সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধ্যক্ষ কিন্তু ছিলেন সেই প্রমথনাথ বসু, পরে যদিও তিনি রেক্টর পদে আসীন হন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে (Jadavpur University) আজও তাঁর নামে পুরস্কার প্রদান করা হয়। শুধু ভারত নয়, লন্ডনের জিওলজিক্যাল সোসাইটিরও (London Geological Society) সদস্যপদ পেয়েছিলেন তিনি। নিছক বাঙালি হওয়ার কারণে মেধা ও প্রতিভার যোগ্য সম্মান কিংবা কদর পাননি ভারতে শিল্পায়নের যুগপুরুষ প্রমথনাথ বসু।


প্রমথনাথ তাঁর সারা জীবনের অসংখ্য কীর্তি পিছনে ফেলে ১৯৩৪ সালের ২৭ এপ্রিল পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন। তাঁর মৃত্যুতে অশ্রুভরা চোখে উচ্চারিত হল– ‘‘A great ‘Sadhu’ has passed away.’’

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মুর্খ মানুষ দের চেনের কিছু লক্ষণ। Murkho manush der chener upai

CRASH and LOVE

প্রেষণা বা Motivation কি? প্রেষণার চক্র! প্রেষণার তত্ত্ব -