মহা শিব রাত্রির আধ্যাত্মিক রহস্য
💥 *মহা শিব রাত্রির আধ্যাত্মিক রহস্য* 💥
ভারতীয় জনমানসে এই মান্যতা আছে যে, *শিবের* মধ্যে সৃজন আর সংহারের ক্ষমতা আছে l তারা এও মানে যে শিব হলেন *আশুতোষ* অর্থাৎ সহজেই প্রসন্ন হন l এই ভাবনায় তারা শিবকে জল স্নান করায়, তাঁর পূজা করে l কিন্তু প্রশ্ন হলো, সারাজীবন শিব পূজা করেও তথা প্রতি বছরে শ্রদ্ধাপূর্বক শিবরাত্রিতে জাগরণ, ব্রত ইত্যাদি করেও মানুষের পাপ বা সন্তাপ কেন দূর হয় না ? তাদের মুক্তি বা জীবন মুক্তি অথবা শক্তির প্রাপ্তি কেন হয় না ? তাদের রাজ্য - ভাগ্যের অমর বরদান কেন প্রাপ্ত হয় না ? আসলে শিবকে প্রসন্ন করার প্রকৃত বিধি কি ❓শিবরাত্রির বাস্তবিক রহস্য কি ❓আমরা সত্য শিবরাত্রি কিভাবে পালন করবো ❓"শিবের" রাত্রির সঙ্গে কি সম্পর্ক, যেখানে অন্য দেবতার পূজা অর্চনা দিনে হয়ে থাকে ❓
*শিবরাত্রির* সঙ্গে জুড়ে থাকা এমন সব প্রশ্নের উত্তর তাঁর আধ্যাত্মিক রহস্যের উন্মোচন করে থাকে l
মহারাত্রি হলো পাপাচার আর ঘোর অজ্ঞানতার সূচক l *শিবরাত্রি* ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অন্তিম রাত্রির ( অমাবস্যা ) এক দিন পূর্বে পালিত হয় l এই লোকে পরমপিতা পরমাত্মা *শিবের* অবতরণ কলিযুগের অন্তিম সময়ের কিছু বর্ষ পূর্বে হয়েছিলো যখন সম্পূর্ণ সৃষ্টি অজ্ঞান অন্ধকারে আবৃত ছিলো l এই কারণে শিবের সম্বন্ধ রাত্রির সঙ্গে যুক্ত হয় আর পরমাত্মা শিবের রাত্রে পূজার অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় l
শ্রী নারায়ণ বা শ্রী রাম আদি দেবতাদের পূজা তো দিনে হয়ে থাকে, কেননা শ্রী নারায়ণ বা শ্রী রামের জন্ম ক্রমশ সত্যযুগ আর ত্রেতাযুগে হয়েছিলো l মন্দিরে ওই দেবতাদের রাতে শয়ন দেওয়া হয় আর দিনে তাঁদের জাগানো হয় l কিন্তু পরমাত্মা শিবের পূজার জন্য ভক্তরা স্বয়ং রাত্রি জাগরণ করে l আজ পূর্ব লিখিত রহস্যকে না জানার কারণে কেউ কেউ বলে থাকে শিব তমোগুণের অধিষ্ঠাতা l তাই শিবের পূজা রাত্রে হয় আর এর স্মরণে শিবরাত্রির পালন হয় l কেননা রাত্রি হলো 'তমোগুণের' প্রতীক, কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল, বাস্তবে শিব তমোগুণের অধিষ্ঠাতা নন বরঞ্চ তমোগুণের সংহারক বা নাশক l যদি শিব তমোগুণের অধিষ্ঠাতা হতেন, তাহলে তাঁকে *শিব* অর্থাৎ *কল্যাণকারী*, পাপ কাটেশ্বর এবং মুক্তেশ্বর আদি বলা নিরর্থক হয়ে যায় l *শিব* শব্দের অর্থ হলো *কল্যাণকারী* l শিবের কর্তব্য আত্মাদের কল্যাণ করা, যেখানে তমোগুণের অর্থ হলো *অকল্যাণকারী* l এ হলো পাপবর্ধক এবং মুক্তির বাধক l বাস্তবে *শিবরাত্রি* এই কারণে পালন করা হয়, কেননা পরমাত্মা শিব কল্পের অন্তে অবতরিত হয়ে অজ্ঞানতা,দুঃখ আর অশান্তি সমাপ্ত করেছিলেন l মহাশিবরাত্রির আধ্যাত্মিক গুরুত্ব -- মহাশিবরাত্রির সম্বন্ধে এক মান্যতা আছে যে -- এই রাত্রে পরমপিতা পরমাত্মা শিব মহাসংহার করিয়েছিলেন আর দ্বিতীয় মান্যতা হলো, এই রাত্রে একা ঈশ্বর অম্বা ইত্যাদি শক্তিতে সম্পন্ন হয়ে রচনার কার্য প্রারম্ভ করেছিলেন l কিন্তু প্রশ্ন এই যে -- শিব তো জ্যোতির্লিঙ্গ আর অশরীরি l তিনি সংহার কিভাবে আর কার দ্বারা করাবেন আর নতুন দুনিয়া স্থাপনের স্পষ্ট রূপরেখা কি ? জ্যোতিস্বরূপ পরমপিতা, পরমাত্মা শিব প্রজাপিতা ব্রহ্মার দ্বারা সত্যযুগী সতোপ্রধান সৃষ্টির স্থাপনা আর শঙ্করের দ্বারা কলিযুগী তমোপ্রধান সৃষ্টির মহাবিনাশ করান l তিনি কলিযুগের অন্তে ব্রহ্মার শরীরে প্রবেশ করে তাঁর মুখ কমল দ্বারা জ্ঞান গঙ্গা প্রবাহিত করেন l এই কারণে শিবকে *গঙ্গাধর*বলা হয় আর *সুধাকর* অর্থাৎ অমৃত দানকারীও বলা হয় l প্রজাপিতা ব্রহ্মার দ্বারা যে ভারত মাতারা আর কন্যারা শিবের এই জ্ঞান গঙ্গায় স্নান করেন বা জ্ঞান সুধামৃত পান করেন, তাঁরা শিব শক্তি অথবা অম্বা, সরস্বতী ইত্যাদি নামে বিখ্যাত হন l চৈতন্য জ্ঞান গঙ্গারা বা ব্রহ্মার মানস পুত্রীরা শিবের আদেশ পেয়ে ভারতের জনমনকে শিব জ্ঞানের দ্বারা পবিত্র করেন, তাই শিবকে নারীশ্বর, পাপ কাটেশ্বর, পতিত পাবনও বলা হয়, কেননা মনুষ্য আত্মাদের শক্তিস্বরূপা নারীদের অথবা মাতাদের জ্ঞান দান করে পবিত্র করেন তিনি, তথা বিকার রূপী বিষ পান করে তাদের কল্যাণ করেন, আর তাদের সহজেই মুক্তি বা জীবন মুক্তির বরদান করেন l
তিনি সকল মনুষ্য আত্মাকে শরীর থেকে মুক্ত করে শিবলোকে নিয়ে যান l এইজন্য তাঁকে মুক্তেশ্বরও বলা হয় l কিন্তু এই দুই কার্য কলিযুগের অন্তিম সময়ে, অজ্ঞান রূপী রাত্রির সময় শিবের দ্বারা সম্পন্ন হয় l
এই জন্য এটাই স্পষ্ট যে শিবরাত্রি এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তান্তের স্মরণোৎসব l এ হলো সমগ্র সৃষ্টির সমস্ত মনুষ্য আত্মাদের পারলৌকিক পরমপিতা পরমাত্মার দিব্য জন্মদিবস আর সকলেরই মুক্তি আর জীবনমুক্তি রূপী সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তির স্মরণের দিন l এই কারণেই শিবরাত্রি সমস্ত জন্মোৎসব বা জয়ন্তীর তুলনায় সর্বোৎকৃষ্ট ,কেননা অন্য সব জন্মোৎসব তো মনুষ্য আত্মা বা দেবতাদের জন্মদিনের স্মরণে পালন করা হয়, যেখানে শিবরাত্রি মানুষকে দেবতা বানানোর জন্য,দেবেরও দেব, ধর্মপিতাদেরও পিতা, সদ্গতিদাতা, পরমপ্রিয়, পরমপিতা পরমাত্মার দিব্য এবং পরম কল্যাণকারী স্মরণোতৎসব l এই উৎসব সমস্ত সৃষ্টির সকল মানুষের আনন্দের সঙ্গে পালন করা উচিত, কিন্তু আজ মনুষ্য আত্মার পরমপিতা পরমাত্মাকে যথার্থভাবে না জানার কারণে অথবা পরমপিতা শিবকে নাম, রূপ থেকে পৃথক মানার কারণে শিব জয়ন্তীর গুরুত্ব অনেক কম হয়ে গেছে আর মানুষ ধর্মের নামে ঈর্ষা আর লড়াই করছে l প্রকৃত শিবরাত্রি পালনের পরিবর্তে ভক্তরা শিবরাত্রির দিন জাগরণ করে এই ভেবে যে, এতে শিব সন্তুষ্ট হবেন, উপবাস করলে তিনি প্রসন্ন হবেন কিন্তু মানুষকে তমোগুণের নিদ্রা, আর দুঃখ দেওয়ার মাদকতা হলো পাঁচ বিকার l যতক্ষণ না মানুষ এই পাঁচ বিকার ত্যাগ করতে পারছে, ততক্ষণ তাদের আত্মার পূর্ণ জাগরণ সম্ভব নয় আর ততক্ষণ আশুতোষ ভগবান শিবও তাদের প্রতি প্রসন্ন হবেন না কেননা ভগবান শিব স্বয়ং কামজয়ী তিনি কিভাবে কামী মানুষের প্রতি প্রসন্ন হবেন l দ্বিতীয় কথা হলো, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর রাত্রিতে শিবরাত্রি পালন হলো কলিযুগের অন্তে সেই বর্ষের প্রতীক, যখন ভগবান শিব মানুষকে জ্ঞান দ্বারা পবিত্র করে, কল্যাণের পাত্র করে তুলেছিলেন l অত: শিবরাত্রির ব্রত সারাবছর পালন করা উচিত, কেননা বর্তমান *পুরুষোত্তম সঙ্গমযুগে পরমাত্মার অবতরণ হয়েছে* l এই কলিযুগী সৃষ্টির মহাবিনাশের সামগ্রী অ্যাটম বোম, হাইড্রোজেন, পরমাণু বোমার রূপে তৈরী হয়েছে এবং *পরমপ্রিয় পরমাত্মা শিববাবার দ্বারা বিশ্ব নব নির্মাণ কার্য চলছে* l এখন মহাবিনাশের সময় পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করা উচিত যাতে এই মনোবিকারের উপর জ্ঞান আর যোগের দ্বারা বিজয় প্রাপ্ত করা যায় l
এই হলো মহাব্রত যা *শিবব্রত* নামে প্রসিদ্ধ আর এই হলো বাস্তবে শিবের মন্ত্র যা *তারক মন্ত্র* নামেও প্রসিদ্ধ কেননা এই ব্রত বা মন্ত্রেই মনুষ্য আত্মা এই সংসার রূপী বিষয় সাগর থেকে উদ্ধার হয়ে শিবলোকে চলে যায় l পরমাত্মা শিব ঈশ্বরীয় জ্ঞান আর রাজযোগের শিক্ষার দ্বারা সর্ব মনুষ্য আত্মাদের পবিত্র করছেন l আপনিও *পরমাত্মার* সঙ্গে প্রকৃত শিবরাত্রি পালন করে জন্ম জন্মান্তরের জন্য শ্রেষ্ঠ ভাগ্য প্রাপ্তি করতে পারেন l
*ওম শান্তি* ll
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন