মানুষকে অপমান না করেও সংশোধন করার অসাধারণ শিক্ষা
*মানুষকে অপমান না করেও সংশোধন করার অসাধারণ শিক্ষা*
হঠাৎ একদিন রাস্তায় এক বৃদ্ধের সাথে এক যুবকের দেখা। যুবক একটু আগ বাড়িয়ে গিয়ে সম্বোধন করে বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, টিচার আমাকে চিনতে পেরেছেন ? উত্তরে বৃদ্ধ বললেন না ! আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। অতপর বৃদ্ধ জানতে চাইলেন আমি কি তোমাকে চিনি?
যুবক বললো হ্যাঁ স্যার আমি একসময় আপনার ছাত্র ছিলাম। ও আচ্ছা! বলে সেই বৃদ্ধ যুবকের কাছে কুশলাদি জানার পর জিজ্ঞাসা করলেন এখন তুমি কি করছো? যুবক অত্যন্ত বিনয়ের সাথে উত্তরে বললো আমি একজন শিক্ষক। বর্তমানে শিক্ষকতা করছি।
প্রাক্তন ছাত্রের মুখ থেকে এই কথা শুনে বৃদ্ধ শিক্ষক অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন "বাঃ বাঃ খুব ভালো, আমার মতো হয়েছো তাহলে?"
হ্যাঁ ঠিক! আসলে আমি আপনার মতো একজন শিক্ষক হতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি। তখন সেই যুবক এর পিছনের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বললো আপনি আমাকে আপনার মতো হতে শিক্ষক হতে অনুপ্রাণিত করেছেন। উদ্ধুদ্ধ করেছেন।
বৃদ্ধ শিক্ষক কিছুটা কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে যুবকের কাছে শিক্ষক হওয়ার পিছনের কারণ জানতে চাইলে, সেই যুবক তার শিক্ষক হয়ে উঠার গল্প বলতে গিয়ে বৃদ্ধ শিক্ষককে স্মরণ করিয়ে দিলো স্কুলে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা। সে দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে যুবক তখন বৃদ্ধ শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললো; মনে আছে স্যার -
একদিন আমার এক সহপাঠি বন্ধু যে আপনারও ছাত্র ছিল, সে একটি নতুন ঘড়ি নিয়ে ক্লাসে এসেছিল। তার ঘাড়িটি এতটাই সুন্দর ছিল যে আমি লোভ সামলাতে পারিনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ঘড়িটি আমার চাই। অতপর আমি তার পকেট থেকে ঘড়িটি চুরি করি।
কিছুক্ষণ পর আমার সেই বন্ধু তার ঘড়ির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করে এবং অবিলম্বে আমাদের টিচার অর্থাৎ আপনার কাছে অভিযোগ করে। তার এই অভিযোগ শুনে আপনি ক্লাসের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আজ ক্লাস চলাকালীন এই ছাত্রের ঘড়িটি চুরি হয়েছে। যে চুরি করেছো, দয়া করে ঘাড়িটি ফিরিয়ে দাও।
হ্যাঁ আপনার বার্তা শুনেও আমি ঘাড়িটি ফেরত দেইনি, কারণ ঘড়িটা আমার কাছে খুব লোভনীয় ছিল। তারপর দরজা বন্ধ করে আপনি সবাইকে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাসরুমের ফ্লোরের মধ্যে একটি গোলাকার বৃত্ত তৈরি করতে বললেন এবং সবাইকে চোখ বন্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। এরপর ঘড়ি না পাওয়া পর্যন্ত আপনি এক এক করে আমাদের সবার পকেট খুঁজতে লাগলেন।
আমরা সবাই আপনার নির্দেশ মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
আপনি এক এক করে পকেট চেক করে একটা সময় আপনি যখন আমার পকেটে হাত দিয়ে ঘড়িটি খুঁজে পেলেন তখন ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। কিন্তুু সেই মুহূর্তে ঘাড়িটি আমার পকেটে পাওয়ার পরও আপনি কিছু বলেননি এবং শেষ ছাত্র পর্যন্ত সবার পকেট চেক করছিলেন। সবশেষে আপনি সবাইকে বললেন ঘড়ি পাওয়া গেছে। এবার তোমরা সবাই চোখ খুলতে পারো। ঘড়িটি পাওয়ার পর আমার সেই বন্ধুটি আপনার কাছে জানতে চেয়েছিল ঘড়িটি কার পকেটে পাওয়া গিয়েছিল? কিন্তুু আপনি তাকে বলেছিলেন, ঘড়িটি কার পকেটে পাওয়া গেছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার ঘড়ি পাওয়া গেছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
সেই দিনের ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে আপনি আমার সাথে কোনো কথা বলেননি। এমনকি সে কাজের জন্য আপনি আমাকে তিরস্কারও করেননি। নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য আপনি আমাকে স্কুলের আলাদা করে কোনো রুমেও নিয়ে যাননি। সেই ঘটনা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক দিন। অথচ আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে, কৌশল অবলম্বন করে চুরি হওয়া ঘড়িটি উদ্ধার করলেন এবং আমার মর্যাদা চিরতরে রক্ষা করলেন।
সেই ঘটনার পর আমি অনেকদিন অনুশোচনায় ভুগেছি। ক্লাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ সে দিন চলে গেলেও এর প্রভাব রয়ে যায় আমার মনের মধ্যে। বিবেকের যুদ্ধে বার বার দংশিত হয়েছি। তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এমন অনৈতিক কাজ আর কখনো করব না। একজন ভালো মানুষ হবো। একজন শিক্ষক হবো। সত্যিকার অর্থে মানুষ গড়ার কারিগর হবো। আপনার কাছ থেকে সে দিন আমি স্পষ্টভাবে বার্তা পেয়েছিলাম প্রকৃতপক্ষে কি ধরণের একজন শিক্ষাবিদ হওয়া উচিত। অপমান ছাড়াও মানুষকে সংশোধন করা যায় সেটি আপনার কাছ থেকে শিখেছি। আপনার উদারতা এবং মহানুভবতা আজ আমাকে শিক্ষকের মর্যাদায় আসীন করেছে।
সাবেক ছাত্রের কথাগুলো শুনে বৃদ্ধ শিক্ষক বললেন হ্যাঁ সেই ঘটনা আমার মনে আছে। চুরি হওয়া ঘড়ি আমি সবার পকেটে খুঁজেছিলাম। কিন্তুু আমি তোমাকে মনে রাখিনি, কারণ সে সময় আমার চোখও বন্ধ ছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন